রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে ঐতিহাসিক ২০ মে ” চা শ্রমিক দিবস “পালিত
প্রকাশিত:শুক্রবার, ২০ মে ২০২২ ০৬:০৫
সুরমাভিউ:- যথাযোগ্য মর্যাদায় রক্তস্নাত ২০ মে ” মুল্লুক চল আন্দোলন ” এর ১০১ তম বার্ষিকী নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এর চা বাগানে সকাল ৮ টায় প্রত্যেক চা বাগানে অস্থায়ী শহীদ বেদী নির্মাণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এছাড়া এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল যে চাঁদপুর জেলায় সেখানেও বড় স্টেশন (পুরনো স্টীমার ঘাট) অস্থায়ী শহীদ বেদী নির্মাণ করে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে সিলেটের লাক্কাতুরা, মালনীছড়া, দলদলি, কেওয়াছড়া, হিলুয়াছড়া, ছড়াগাঙ্গ, খান চা বাগান সহ প্রত্যেক চা বাগানে সকাল ৮ টায় অস্থায়ী শহীদ বেদী নির্মাণ করে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়।
বিকাল ৩ টায় নগর ভবন পয়েন্ট থেকে চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার, দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা সহ ১০ দফা দাবিতে একটি সুসজ্জিত র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ এর সাহিত্য আসর কক্ষে বিকাল ৩ টা ৩০ মিনিটে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কমরেড জহিরুল ইসলাম, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন এডভোকেট, গণতন্ত্রী পার্টি সিলেট জেলার সভাপতি জনাব আরিফ মিয়া, চা শ্রমিক ফেডারেশন এর উপদেষ্টা কমরেড উজ্জ্বল রায়, বিশিষ্ট সাংবাদিক সজল ছত্রী, শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন এর সিলেট জেলা আহ্বায়ক মোখলেছুর রহমান।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন লাক্কাতুরা চা বাগান এর হৃদয় লোহার, বন্যা বাহাদুর, ছড়াগাঙ্গ চা বাগান এর খোকন ছত্রী, খান চা বাগান এর গীতা ওরাং, মালনীছড়া চা বাগান এর নমিতা রায়, হিলুয়াছড়া চা বাগান এর রবি মাল, কেওয়াছড়া চা বাগান এর সঞ্জীব, দলদলি চা বাগান এর হরি দাস প্রমুখ।
আলোচনা সভায় নেতৃবৃন্দ বলেন, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান প্রথম বানিজ্যিক ভাবে চালু হয়।এ লাভজনক চা চাষের জন্য ‘গাছ হিলায়গা তো পয়সা মিলে গা’ এই মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের বিহার, উরিষ্যা,মাদ্রাজ,উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে দরিদ্র কৃষকদের আজীবন কাজের শর্তে এ অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়।দরিদ্র কৃষক মালিক শ্রেণির মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করে এ অঞ্চলে এসে পাহাড় জঙ্গল কেটে চা চাষ করতে গিয়ে বাঘ সিংহের আক্রমণে, সাপ- জোক- পোকামাকড়ের কামরে মৃত্যুবরন করেছে।এর বিনিময়ে শ্রমিকদেরকে বাঁচার মত মজুরি, রেশন দেওয়া হত না, ছোট কুড়েঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। শ্রমিকরা এই অত্যাচারের প্রতিবাদে বাগান ছেড়ে নিজ মুল্লুকে ফিরে যাওয়ার জন্য পন্ডিত দেওশরন ও পন্ডিত গঙ্গা দয়াল দিক্ষীতের নেতৃত্বে আন্দোলনের ডাক দেয়।১৯২১ সালের ২০ মে প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক শত শত মাইল পায়ে হেঁটে চাঁদপুর স্টিমারঘাটে জড়ো হয়।বৃটিশ সরকার ও মালিকদের নির্দেশে গোর্খা পুলিশ বাহিনীর নির্বিচার লাঠিচার্জ ও গুলিতে শত শত শ্রমিক আহত ও নিহত হয়।শ্রমিকদের লাশ মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।আহত শ্রমিকদের পাশে দাড়ান দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মাষ্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম থেকে সেচ্ছাসেবকরা আহত শ্রমিকদের সেবা প্রদান করে। রেলওয়ে শ্রমিক, স্টিমার শ্রমিক এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনের সমর্থনে ধর্মঘট পালন করে।নানা আশ্বাস দিয়ে চা শ্রমিকদের পূণরায় বাগানে ফিরিয়ে আনা হয়।
১০১ বছর পূর্বে যে কারণে শ্রমিকরা প্রতিবাদ করেছে নিজ মুল্লুক ফিরে যেতে চেয়েছে, আজ চা শ্রমিকদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, গত ২০১৯-২০২০ সালের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় ১৭ মাস।এখনও নতুন চুক্তি ২০২১-২০২২ করার কোন উদ্যোগ নেই।চুক্তি দেরিতে হলে স্থায়ী শ্রমিকরা এরিয়ার বিল পেলেও অস্থায়ী শ্রমিকরা কোন এরিয়ার বিল পায় না। নীতিমালা অনুযায়ী ৩/৬ মাসের মধ্যে অস্থায়ী শিক্ষানবিশ (ঠিকা) চা শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের সিদ্ধান্ত থাকলেও চা বাগানগুলোতে তা কার্যকর হচ্ছে না। চা বাগান মালিক পক্ষ, শ্রমিক পক্ষ, সরকারি প্রতিনিধিদের যৌথ খসড়া গেজেট ২০২১- এ ৩ বছর অন্তর নতুন চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। গেজেটের এ প্রস্তাবসহ বিভিন্ন ধারা উপধারায় শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে চুক্তির মেয়াদ পূর্বের মতো ২ বছর অন্তর বহাল রাখার দাবিতে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ পর্যন্ত এর কোন জবাব পাওয়া যায়নি। মুল্লুক চল আন্দোলন এর ১০১ তম বর্ষেও চা শ্রমিকদের সুখের স্বপ্ন পূরণ হয়নি।চা শ্রমিকরা আজীবন দলীয় ভোটব্যাংক এবং মালিকদের মুনাফা লুটার হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহৃত হয়ে আসছে।
দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি ও সপ্তাহে আড়াই কেজি পঁচা আটা রেশন দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।১৬৮ বছর যাবৎ বসবাস করলেও ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাগানে এম বি বি এস ডাক্তার না থাকায় অনেককে অকালে জীবন দিতে হয়।মাত্র ৬ টি বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বেশিরভাগ বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। শ্রমিকদের পেনশন সুবিধা নেই নানা ভাবে চা বাগানের জমি দখল করার পায়তারা চলছে এর বিরুদ্ধে সকল চা শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। এই আন্দোলনে সমাজের সকল সচেতন বিবেকবান মানুষকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।